খনিজ সম্পদ (তেল ও গ্যাস ব্যতীত) খাত প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ
বিগত দশ বছরে অন্যান্য খাতের ন্যয় খনিজ সম্পদ খাতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে। সরকার খনি ও খনিজ সম্পদ (নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন) আইন, ১৯৯২ (১৯৯২ সালের ৩৯ নং আইন) আইনের ধারা ৪ এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে খনি ও খনিজ সম্পদ বিধিমালা, ২০১২ প্রণয়ন করেছে। এ ছাড়া, সাদা মাটি উত্তোলন ও বিপনণ নির্দেশিকা, ২০১৪ প্রণয়ন করা হয়েছে। বিদ্যমান আইন ও বিধিমালার আলোকে দেশে প্রাপ্ত তেল ও গ্যাস ব্যতীত অন্যান্য খনিজ সম্পদের উৎস অনুসন্ধান করে খনিজ সমুদ্ধ এলাকা হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছে যা বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে খনি ও খনিজ সম্পদ বিধিমালা, ২০১২ অনুসরণে খনিজ সম্পদ (তেল ও গ্যাস ব্যতীত) অনুসন্ধান এবং আহরণ/উত্তোলনের লক্ষ্যে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি) কর্তৃক অনুসন্ধান লাইসেন্স, খনি ইজারা ও কোয়ারি ইজারা প্রদান অব্যাহত আছে।
তেল ও গ্যাস ব্যতীত দেশে প্রাপ্ত অন্যান্য খনিজ সম্পদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো (১) কয়লা (২) কঠিন শিলা (৩) সাধারণ পাথর/বালু মিশ্রিত পাথর (৪) সিলিকা বালু এবং (৫) সাদামাটি। নিম্নে এ সমস্ত খনিজ সম্পদের সার্বিক চিত্র সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
কয়লা (Coal)
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৫টি কয়লা ক্ষেত্র আবিস্কৃত হয়েছে। আবিস্কৃত ৫টি কয়লা ক্ষেত্রে কয়লার মোট মজুদের পরিমাণ আনুমানিক ৩৩০০ মিলিয়ন টন। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ইট ভাটায় জ্বালানি হিসাবে কয়লার ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো কর্তৃক বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএমসিএল)-এর অনুকূলে দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলায় কয়লা উত্তোলনের জন্য ১৯৯৪ সালে খনি ইজারা মঞ্জুর করা হয়। বর্তমানে উক্ত কয়লাক্ষেত্র থেকে ভূ-গর্ভস্থ খনি পদ্ধতিতে (Under Ground Mining Process) কয়লা উত্তোলন অব্যাহত রয়েছে এবং উত্তোলিত কয়লা দ্বারা কয়লা খনি এলাকায় অবস্থিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে ৫২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ উৎপাদিত কয়লা বিক্রয় করে সরকারি রাজস্ব আদায় করা হচ্ছে। এছাড়া, দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার দীঘিপাড়ায় কয়লা অনুসন্ধানের জন্য পেট্রোবাংলার অনুকূলে ২১.১২.২০০৮ তারিখে অনুসন্ধান লাইসেন্স প্রদান করা হয়। অনুসন্ধান কার্যক্রমের অধিকতর উন্নয়ন এবং ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে পেট্রোবাংলার সাথে সম্পাদিত উক্ত অনুসন্ধান চুক্তি ২১.১০.২০১৫ তারিখে বিসিএমসিএল-এর অনুকূলে হস্তান্তর করা হয়েছে। বর্তমানে বিসিএমসিএল কর্তৃক কয়লাক্ষেত্রটির অনুসন্ধানকল্পে ফিজিবিলিটি স্টাডি কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
কঠিন শিলা (Hard Rock)
বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) কর্তৃক ১৯৭৪ সালে দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলায় ১২৮ মিটার গভীরতায় আবিষ্কৃত প্রিক্যামব্রিয়ান যুগের ২৫০ কোটি বছরের অতি পুরাতন ভিত্তি/কঠিন শিলা উত্তোলনের লক্ষ্যে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো কর্তৃক গত ১১.০৭.১৯৯৪ তারিখে মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (এমজিএমসিএল)-এর অনুকূলে খনি ইজারা মঞ্জুর করা হয়। এমজিএমসিএল কর্তৃক প্রথমে খনি উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় নভেম্বর ২০০৫ পর্যন্ত সহজাত হিসেবে এবং অক্টোবর ২০০৬ পর্যন্ত Trial/Testing Production এর আওতায় কঠিন শিলা উত্তোলন শুরু হয়। পরবর্তীতে মে ২০০৭ হতে বণিজ্যিকভাবে কঠিন শিলা উত্তোলন কার্যক্রম শুরু হয়েছে যা বর্তমান অবধি চলমান রয়েছে। উত্তোলিত কঠিন শিলা দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রাখাসহ সরকারি রাজস্ব আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ।
সাধারণ পাথর/বালু মিশ্রিত পাথর (Ordinary Stone/Sand Mixed stone)
তেল ও গ্যাস ব্যতীত দেশে প্রাপ্ত অন্যান্য খনিজ সম্পদসমূহের মধ্যে সাধারণ পাথর/বালু মিশ্রিত পাথর অন্যতম। দেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট ও বান্দরবান পার্বত্য জেলায় সাধারণ পাথর/বালু মিশ্রিত পাথরের মজুদ রয়েছে। এ সমস্ত জেলার সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত জমিতে বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) কর্তৃক জরিপকার্য পরিচালনা করে ৫০ (পঁঞ্চাশ)টি পাথর সমৃদ্ধ এলাকাকে কোয়ারি হিসাবে ঘোষনা করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ কর্তৃক গেজেটভুক্ত করা হয়েছে যা ১৪ মার্চ, ২০১৩ তারিখে বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত হয়েছে। গেজেটভুক্ত এলাকা ছাড়াও বর্ণিত জেলাসমূহে এবং নীলফামারী জেলায় ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে পাথরের ব্যাপক মজুদ রয়েছে। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে এবং স্থানীয় পাহাড়ী ঢলের মাধ্যমে কোয়ারিসমূহে কিছু পাথর/বালু মিশ্রিত পাথরে নতুন করে জমা হয়। খনি ও খনিজ সম্পদ বিধিমালা, ২০১২-এর বিধি ৭৮ অনুযায়ী সাধারণ পাথর/বালু মিশ্রিত পাথর কোয়ারি ইজারা সংক্রান্ত জেলা কমিটির সুপারিশ ও সরকারের অনুমোদনক্রমে খাস খতিয়ানভুক্ত ভূমির পাথর কোয়ারিসমূহ ইজারা প্রদান অব্যাহত রয়েছে।
সিলিকা বালু (Silica Sand)
খনি ও খনিজ সম্পদ বিধিমালা, ২০১২-এর বিধি ২(২৫) অনুযায়ী যে সমস্ত বালুতে ৯০% এর অধিক সিলিকন-ডাই-অক্সাইড (SiO2) রয়েছে সে বালুকে ‘সিলিকা বালু’ বলা হয়। সিলিকা বালু গ্লাস ও সিরামিক শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি নির্মাণ কাজেও ব্যবহৃত হয়। সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলায় সিলিকা বালু পাওয়া যায়। বিদ্যমান আইন ও বিধিমালার আলোকে সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত ভূমির সিলিকা বালু কোয়ারিসমূহ বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) কর্তৃক জরিপকার্য পরিচালনা করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ কর্তৃক খনিজ সম্পদ হিসেবে গেজেটভুক্ত করা হয়েছে, যা ২৭ জুন, ২০১৩ তারিখে বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত হয়েছে। গেজেটভুক্ত/ঘোষিত মোট সিলিকা বালু কোয়ারির সংখ্যা ৭৮ (আটাত্তর)টি। গেজেটভুক্ত এলাকা ছাড়াও বর্ণিত জেলাসমূহে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে সিলিকা বালুর ব্যাপক মজুদ রয়েছে। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে এবং স্থানীয় পাহাড়ী ঢলের দ্বারা কোয়ারিসমূহে যে বালুর সঞ্চায়ন ঘটে তা ইজারাদারগণ ইজারাকৃত সময়ে অপসারণ করে থাকেন। তাই সিলিকা বালু কোয়ারিসমূহে বালুর প্রকৃত মজুদ নির্ণয় করা সম্ভব নয়।
খনি ও খনিজ সম্পদ বিধিমালা, ২০১২-এর বিধি ৭৮ অনুযায়ী সিলিকা বালু কোয়ারি ইজারা সংক্রান্ত জেলা কমিটির সুপারিশ ও সরকারের অনুমোদনক্রমে খাস খতিয়ানভুক্ত/গেজেটভুক্ত সিলিকা বালু কোয়ারিসমূহ ইজারা ইজারা প্রদান করা হয়ে থাকে।
সাদামাটি (White Clay)
খনি ও খনিজ সম্পদ (নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন ) আইন, ১৯৯২ (১৯৯২ সালের ৩৯নং আইন) এর ধারা ২(খ)(অ) এর বিধানমতে সিরামিক, রিফ্র্যাক্টরী ও শোষণক্ষম সম্বন্ধীয় জিনিস তৈরীতে ব্যবüত ক্লে বা সাদামাটি/চিনামাটি (White Clay/China Clay) একটি খনিজ সম্পদ। খনি ও খনিজ সম্পদ বিধিমালা, ২০১২ এর আলোকে সাদামাটি উত্তোলন ও বিপণন নির্দেশিকা, ২০১৪ প্রণয়ন করা হয়েছে। উক্ত নির্দেশিকা অনুয়ায়ী ৭ (সাত) সদস্য বিশিষ্ট জেলা মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। উক্ত কমিটি সাদামাটি কোয়ারি ইজারা প্রদান, সাদামাটি উত্তোলন ও অপসারণসহ সকল কার্য়ক্রম পরিচালনা করে থাকে। দেশের নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ ও শেরপুর জেলার দূর্গাপুর, ধোবাউড়া, হালুয়াঘাট, শ্রীবদী, নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতি উপজেলায় সাদামাটির মজুদ রয়েছে। উক্ত ৬ (ছয়)টি উপজেলায় পাহাড়ী ও সমতল ভূমিতে মোট ৩৪০.৭৪ মিলিয়ন টন সাদামাটি মজুদ রয়েছে (তথ্যসূত্র-বিএমডি ও জিএসবি)।
পরিশেষে বলা যায় তেল ও গ্যাস ব্যতীত অন্যান্য খনিজ সম্পদের অনুসন্ধান কল্পে অনুসন্ধান লাইসেন্স এবং আহরণ/উত্তোলনের লক্ষ্যে খনি ইজারা ও কোয়ারি ইজারা প্রদানকারী সংস্থা খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি) কে আরও শক্তিশালী করা গেলে খনিজ সম্পদ খাত আরও এগিয়ে যাবে বলে আশা করা যায়।
লেখক : এস.এম. আশরাফুল আবেদীন আশা, সহকারী পরিচালক, খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি)।
কপিরাইট © 2023 বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয়